ভালোবাসার এই তো সময়।
বিচ্ছেদের সময় আসবে। আসবেই। সবার লাইফে। বারবার। নানা রূপে। বাবার বদলির চাকরি হলে খুব ছোটবেলাতেই হারাতে হবে প্রিয় বারান্দা, প্রিয় ছাদ, স্কুলের রাস্তায় লজেন্সের দোকান। এক লহমায় ঘরের জানলার বাইরের দুনিয়াটা বদলে যাবে। বিছানা থেকে উঠেই বা-দিকের জানলাটা নতুন বাড়িতে এসে হয়ত হয়ে যাবে মাথার পিছনে। বিচ্ছেদ হবে পাড়ার বন্ধুদের সাথে। উঠোনে ঘুরে বেড়ানো কালো কুকুরটার সাথেও।
শুধু স্কুল বা কলেজ তো নয় !! প্রতিদিন কত মানুষ ধর্মতলা থেকে, হাওড়া স্টেশন থেকে, দমদম এয়ারপোর্ট থেকে ব্যাগ কাধে ছেড়ে চলে যাচ্ছে তার প্রিয় শহর। নিজভূমে আর কখনওই ফেরা হবে না জেনেও। এই শহরের মাটিতে তার পা পড়বে না। এই শহরের হাওয়া তার মুখে এসে লাগবে না। মাঝে মধ্যে হয়ত ফিরবে ছুটিতে, পুজোতে। বছরে এক-দুবার। তারপর দু-চার বছরে একবার। তারপর দশ বছরে। তারপর একদিন তার বন্ধুরা, আত্মীয়রা বলাবলি করবে সে আর নেই। চলে গেছে না ফেরার দেশে।
মৃত্যু – সেটাও তো বিচ্ছেদ। কিন্তু সে তো অবশ্যম্ভাবি। হবেই। কিন্তু যে বিচ্ছেদগুলো না হলেও পারতো, সেগুলো ?? দুই বন্ধুর গলায় গলায় ভাব। এক সাইকেলে সারা গ্রাম চষে বেড়াতো। হঠাৎ না জানি কি কারণে তারা এখন কথা বলে না। মুখ দেখা দেখি বন্ধ। রাতের বেলায় একা একা মদ খেয়ে দুজনেই হয়ত আফশোস করে। কি কারণে বিচ্ছেদ কারো মনে নেই !! তবু এক অদৃশ্য দেওয়াল। ভাঙা যায় না। সাত সমুদ্র পেরিয়ে আসা যায়, মুখোমুখি সাত পা ডিঙানো যায় না।
গোটা কলেজে যাদের প্রেম বিখ্যাত ছিল। যাদের প্রেমের নামে লোকে উদাহরণ দিত। বিয়ের কিছু বছরেই তাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। দুজনেই একা থাকে। দূরে থাকে। অনেক রাতে অচেনা নম্বর থেকে টেলিফোন আসে। কেউ কথা বলে না। নীরব হয়ে বসে থাকে দু-পারে দুটো মানুষ। পাশে কোথাও রেডিওতে বেজে ওঠে দুজনেরই চেনা কোনো গান।
বিয়ে করে মেয়েরা চলে আসে এক অজানা অদ্ভুত জায়গায় যার সাথে তার আগের গোটা জীবনের কোনো মিল নেই। সাপ লুডো খেলায় যেভাবে গুটি পরে যায় একদম নিচের ঘরে। আবার শুরু করতে হয়। সেরকম। তবে বিয়েতে বিচ্ছেদ এবং প্রাপ্তি সমান সমান। ব্যাপারটা কষ্টের এবং মধুরও।
মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরুর আগে স্কুলে শেষ সপ্তাহ। বাংলার স্যার কাঁদছেন। বলছেন, ‘তোরা বেরিয়ে যাবি, স্কুলটাও ফাঁকা হয়ে যাবে। আমিও ভাবছি এই স্কুল ছেড়ে দেব।’ টিচারের কান্না দেখে আমরা তো থ। পনের বছরের ছেলেদের এই আবেগ বোঝা দুঃসাধ্য। পরে বুঝেছিলাম। এই একই কান্না আমরা প্রত্যেকে কেঁদেছি। বহুবার। আগামীতেও কাঁদবো। বিচ্ছেদ আসবেই। বারবার।
তবু সব বিচ্ছেদে কাঁদা যায় না। কান্না চাপা থাকে। একজনের কান্না কাঁদতে হয় বহু বছর পর অন্য কারো বুকে মাথা রেখে। রবীন্দ্র সরোবর। প্রথম দেখা করতে এসেছি একজনের সাথে। অন্ধকারে বসে আছে প্রায় অচেনা দুটো মানুষ। দূরে স্টেশন থেকে ট্রেন চলে যাচ্ছে হুইসেল বাজিয়ে। হঠাৎই কোনো ভূমিকা ছাড়াই, একজনের বুকে মাথা রেখে অন্যজন কাঁদছে। অঁঝোরে। অন্ধকারে। জামার বুক পকেটে জমা হচ্ছে ফোঁটা ফোঁটা জল। ভালোও লাগছে। বুকে মাথা রেখে এর আগে তো কখনও কেউ কাঁদে নি।
– কিন্তু কেন কাঁদছে ?? – পাগল নয় তো ?? – মাথায় ছিঁট নেই তো ?? – যত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারি ভালো !! – আজকেই শেষ, আর দেখা করবো না।
আগামী ছ’বছর তারা একসঙ্গে থাকবে। কিন্তু কোনো দিনও সে বলবে না কেন সেদিন সে কেঁদেছিল। আন্দাজে কিছু একটা ভেবেই মনকে স্বান্তনা দিতে হবে অন্যজনকে।
কথা হচ্ছিল বিচ্ছেদ নিয়ে। বিচ্ছেদ হবেই। মানুষের সাথে। শহরের সাথে। প্রিয় গাছ, প্রিয় ছাদ, প্রিয় খেলনা, প্রিয় বই সবাইকে ছাড়তে হবে। কলেজস্ট্রীটের ফুটপাথ থেকে আপনি কিনে আনবেন একটা পুরোনো বই যার প্রথম পাতায় লেখা থাকবে – জন্মদিনের উপহার, তোমাকে ভুলবো না কোনোদিন।
মানুষ বদলায়। মানুষ ভুলে যায়। রাগ কমে যায়। অভিমান মনে থাকে না। কিন্তু বিচ্ছেদ থেকে যায়। পাহাড়ের অস্থির নদী শান্ত মোহনায় এসে সাগরে মেশার আগে একবার হয়ত ফিরে তাকায়। কিছু দেখা যায় না।
দুজন প্রিয় মানুষের মধ্যেকার রাগ, অভিমান, কষ্ট, না পাওয়া সব আবছা হয়ে আসে। বিশ্বাস করুন দশ বছর পর মনে থাকবে না কি কারণে রাগ হয়েছিল। বাসের জানলায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু মনে পড়বে সে আমায় বড্ড ভালোবাসতো। শুধু সেই বাসতো। সে ছাড়া কেউ ভালোবাসে নি, কখনও না। মনে হবে যদি আবার সব ভুলে ফিরে পাওয়া যেত সেই সময়। আপনি ফিরে তাকাবেন। সাগরে মেশা নদীর মত আপনার চোখও কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপনে আটকে যাবে।
তাই যাদের এখনও বিচ্ছেদ হয় নি। যারা এখনও আপনার আশেপাশে আছে। যারা এখনও হারিয়ে যায় নি। তাদের কাছে কাছে থাকুন। লেগে লেগে থাকুন বেশি বেশি করে। শীতের সকালে জানলা দিয়ে আসা রোদের মত। নরম বিছানায় গুটিসুটি মেরে থাকা বিড়ালছানার মত। হাতে হাত ধরে বলুন ভালোবাসি। তোমাকে হারাতে চাই না। তাকে বুঝিয়ে দিন আপনি তাকে কত ভালোবাসেন। আপনার জীবনে সে কতখানি।
শহরে শীত এসে গেছে। ভালোবাসার এই তো সময়।