যীশুদা – এক পাগল আর্টিস্টের গল্প
অনেক বছর আগের কথা, ঘটনাটা জয়ের মুখে শোনা। জয়ের দাদা একদিন দমদম স্টেশান থেকে ট্রেন ধরার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিল। অন্য প্লাটফর্ম থেকে যীশুদা জয়ের দাদাকে দেখতে পেয়ে ওর নাম ধরে ডেকে ওকে থামায়। জয়ের দাদা ওর হুড়োহুড়ি এবং প্রায় আর্তচীৎকারে বেশ ঘাবড়ে যায়। না জানি কি ঘটনা ঘটেছে ভেবে আঁতকে ওঠে।
ওদিকে দৌঁড়ে দৌঁড়ে লাইন টপকে যীশুদা এই প্লাটফর্মে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ভাই পঁচিশ পয়সা ধার দিবি। বিড়ি কিনতে গিয়ে কম পড়ছে। জয়ের দাদা কোনো মতে নিজেকে সামলে ওকে একটা পঁচিশ পয়সা দেয়।
ঘটনাটা মজার, তবে এখানে শেষ নয়।
কিছুদিন পর আবার একইরকম সকালে দুজনের সেই দমদম স্টেশানে দেখা। যীশুদা যথারীতি ওপার থেকে জয়ের দাদাকে দেখতে পেয়ে থামতে বলে। জয়ের দাদা এবার আর ঘাবড়ায় না। যীশুদা যথারীতি কাছে আসে। এবং জয়ের দাদাকে পঁচিশ পয়সা ফেরত দিয়ে বলে, এই নে তোর সেই পঁচিশ পয়সা।
ঘটনা এইটুকুই, তবে এর অভিঘাত আমার কাছে বিশাল। যখন ঘটনা শুনেছিলাম তখন আমার বয়স দশ কি বারো, প্রায় কুড়ি বছর আগের ঘটনা। এখন ভাবলে অবাক লাগে। একটা লোক পঁচিশ পয়সা ধার নেওয়াটা মনে রাখে, ভোলে না এবং যেই রকম গতিবেগে সেটা ধার চেয়েছিল, সেই একই রকম গতিবেগে সেটা ফেরত দেওয়ারও প্রবণতা রাখে।
আজ দুপুরে হঠাৎ স্বপ্নে যীশুদাকে দেখলাম। একটা পলেস্তারা খসা পুরোনো নোনা ধরা দেওয়ালওয়ালা বাড়ির মেঝেতে বসে দেওয়ালের ভাঙ্গা সিমেন্টে ছবি খুঁজছিল। আমি পাশে গিয়ে বসে একটা সেলফি নেওয়ার চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুতেই সেটা ঠিকমত তুলতে পারছিলাম না।
যীশুদা ছবি আঁকত। আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা ছাত্র। পাড়ায় পাগল বলে বদনাম ছিল। আমার ছোটবেলায় একদিন গভীর রাতে হঠাৎ পাড়ায় তোড়জোড়। যীশুদাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যীশুদার তখন পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়স, আমার দশ বারো হবে। রাত আড়াইটে তিনটের সময় সারা পাড়া যীশুদাকে নানা জায়গায় খুঁজে চলেছে। হুবুহু সব মনে নেই, তবে আন্দাজ করতে পারি সেই সময় পাড়ায় প্রতি দু-পা অন্তর লাইট পোষ্ট ছিল না। সকলের ঘরে হয়ত কারেন্টও ছিল না। হ্যারিকেন মোমবাতি নিয়ে খোঁজা চলছে। পুকুর জঙ্গল তখন এখনকার থেকে বেশী ছিল।
হঠাৎ আবিষ্কার করা হয়, যীশুদা পাড়ার শেষ মাথায় রেললাইনের ধারে বসে ছবি আঁকছে। অন্ধকারে যখন খালি চোখে কিছুই দেখা যাচ্ছে না প্রায়। তখন একটা পাগল ছেলে অন্ধকারের ছবি আঁকছে। বেশ ভালোভাবে মনে আছে, সকলে ডাকলেও, যীশুদা তক্ষুনি ছবি আঁকা ফেলে উঠে বাড়ি চলে আসে নি। ছবিটা কমপ্লিট করেই তবে এসেছিল।
যীশুদা আমাকে প্রথম পেন ড্রাইভ দেখিয়েছিল এবং এর ব্যবহার শিখিয়েছিল। আমি সেই সময় ডাটা ট্রান্সফারের জন্যে ফ্লপি ড্রাইভ ইউজড করতাম। একদিন হঠাৎ যীশুদাআমার বাড়িতে পেনড্রাইভ এনে বলে কিছু প্রিন্ট বার করে দে। আমি তো জিনিসটা দেখেই ঘাবড়ে গেছিলাম। এ কি জিনিস। ও যখন সেটা আমার কম্পিউটারের পিছনে ফিট করছিল, সত্যি কথা আমি মনে মনে বেশ ঘাবড়ে গেছিলাম, এই রে, আমার মেশিনটা খারাপ করে না দেয়।
এই যীশুদারও একটা প্রেমিকা ছিল। খুব সুন্দরী। একই সাথে আর্টকলেজে পড়ত। ওরা বিয়ে করে। কিন্তু দুনিয়াটা বড় গোলমেলে জায়গা বাবুমশায়। এখানে পয়সাই সব। যারা পয়সা চিনেছে তারা বেঁচে গেছে। যারা পয়সার আগে ভালোবাসা, মানবিকতা, শিল্পকে গুরুত্ব দিয়েছে তারা হারিয়ে গেছে, মাঝে মাঝে আমার মত কিছু পাগলের স্বপ্নে এসে দেখা দেয় শুধু।
ওদের বিয়েটা খুব বেশীদিন টেকে না। সুন্দরী বউটি অশান্তি আর অভাবে কেমন জানি শুকিয়ে গেছিল। বাড়ির অমতে আর্টিস্ট পাগল ছেলেকে বিয়ে করে সুখী হয় নি। আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল। একদিন যীশুদাকে ছেড়ে বাচ্চা নিয়ে চলেও যায়। তবে ঐ আর কি। পাগলদের সহজে ভোলা যায় না। তাদের না আছে আত্মসম্মান না আছে লজ্জা। তারা শুধু ভালোবাসতে জানে, নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সঁপে দেয় প্রিয় মানুষটির কাছে। তাকে ছেড়ে তুমি যাবে কিভাবে ? যেভাবেই হোক, কিছু বছর পর তারা আবার এক সাথেই সংসার করা শুরু করে।
আমি অমলকান্তিকে দেখিনি, যে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল কিন্তু শেষমেশ একটি অন্ধকার ছাপাখানায় কাজ করে দিন চালাত। আড্ডা শেষ করে বলত উঠি তাহলে। আমি যীশুদাকে দেখেছি। যখন দেখেছিলাম তখন অনুভব করি নি। আজ অনুভব করি। মানুষ যত কষ্ট পায়, সে তত বড় হয়ে ওঠে। আমি গত দু-বছরে প্রায় কুড়ি বছর বড় হয়ে গেছি। আমি এখন রাস্তার পাগল দেখলে হাসি না, মনে মনে ভাবি কত আঘাত পেলে মানুষ পাগল হয়ে যায়। কেউ আত্মহত্যা করলে তাকে গালাগালি দিই না, ভাবার চেষ্টা করি, কতটা অমানুষিক যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে মানুষের মনে হয়, এর থেকে মরে যাওয়াই ভালো।
মাঝে মাঝে মনে হয়, এত কষ্ট পেয়ে ভালোই হয়েছে। আমি ক্রমশ ‘মানুষ’ হচ্ছি। যখনই কষ্ট পাই, সঙ্গীতার মুখটা ভেসে ওঠে। মধুসূদন মঞ্চের উলটো ফুট থেকে হাসিমুখ করে বাঁশদ্রোনীর বাসে উঠে যাওয়া সতেরো বছরের মেয়েটা জানে না, আমি আর কোনোদিন তার ফোন ধরব না। কোনোদিন তার সাথে দেখা করব না। আমি যে কিনা তার প্রথম প্রেম, আমার সঙ্গে সেটাই তার শেষ দেখা।